স্কুলে শিক্ষকরা পাঠদানের মাধ্যমে শৈশব থেকেই সীসার বিষক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করছেন
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সীসার বিষক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করছেন স্কুল শিক্ষক আবদুল বাতেন মুন্সী
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ‘মা ফাতেমা স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ এর সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ক্লাসটি গতানুগতিক ক্লাসের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।এখানে বইয়ের লেখার বাইরেও শিক্ষার্থীরা নানান বাস্তবধর্মী পাঠ হাতে কলমে শেখে; শেখে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নানা রকম কৌশল ।
ঠিক যেমন এখন বিজ্ঞান শিক্ষক আবদুল বাতেন মুন্সীর ক্লাসে শিক্ষার্থীরা শিখছে শরীরের জন্য নীরব ঘাতক সীসার বিষক্রিয়া এবং এর থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে।
বিজ্ঞান শিক্ষক আবদুল বাতেন সম্প্রতি ইউনিসেফ ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃক আয়োজিত একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামের শিক্ষকদের জন্য আয়োজিত এই প্রশিক্ষণে সীসার বিষক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়; শেখানো হয় বিভিন্ন উদ্ভাবনী শিখন পদ্ধতি; যা পরবর্তীতে বাতেন নিজ শ্রেণীকক্ষে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সীসা বিষয়ে জানতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি তার পাঠদানের বিষয়ের মধ্যেও সীসার বিষক্রিয়ার জটিল সমস্যাগুলো অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সীসার বিষক্রিয়ার মারাত্মক প্রভাব নিয়ে তার শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবি এবং প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন বুকলেট, পোস্টার, ব্যানার ও চার্ট দিয়ে তিনি শ্রেণিকক্ষটি সুন্দরভাবে সাজিয়েছেন। এভাবে আবদুল বাতেন মুন্সী তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে কথা বলার আগ্রহ ও সক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছেন।
শ্রেণিকক্ষটি দেখলে চট করে একটা শব্দ মনে পড়ে যায় - ‘জ্ঞানের গ্যালারি’ যেখানে শিশুরা মজার ছলে কঠিন বিষয়গুলো সহজভাবে শিখতে পারে।
সীসার বিষক্রিয়ার নানা প্রভাব
সীসার বিষক্রিয়াজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশর অবস্থান চতুর্থ । ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স ইভালুয়েশন, ইউনিসেফ ও পিওর আর্থের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিস্ময়করভাবে ৩ কোটি ৫০ লাখ শিশুর রক্তে উচ্চ মাত্রায় সীসা পাওয়া গেছে যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মাত্রার অতিরিক্ত।
সীসার বিষক্রিয়া শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে; লেখাপড়া করার ও নতুন কিছু শেখার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে। এটি শিশুর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী আচরণগত সমস্যাও তৈরী করতে পারে; সীসার প্রভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এটি গর্ভবতী নারীদের জন্যও বিপজ্জনক; সময়ের আগেই সন্তান প্রসব ও গর্ভপাতের কারণ হতে পারে এই সীসা।
শুধু তাই নয়, সীসার বিষক্রিয়ার মারাত্মক প্রভাব পরিবেশের উপরও দেখা যায়; যেমন-এর প্রভাবে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয় এবং গাছপালা ও প্রাণীর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও তাদের প্রজনন হার কমে যায়।
মির্জাপুর উপজেলাটি রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এখানে সীসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। এই এলাকার শিশুদের রক্তের নমুনায় উচ্চমাত্রায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে, আবদুল বাতেনের মতো শিক্ষকরা আশার আলো হিসেবে কাজ করছেন। তারা শুধু বই এর জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে শিক্ষার্থীদের সীসার মতন নানান বাস্তবমুখী চ্যালেঞ্জের সাথে লড়াই করতে শেখাচ্ছেন। তারা স্কুলে পাঠদানের সময় ফ্লিপচার্ট, পোস্টার ও ভিডিও এর মতন নানান আকর্ষণীয় উপকরণ ব্যবহার করে সীসার বিষক্রিয়া সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করছেন। একইসঙ্গে তারা শিক্ষার্থীদের সঠিক স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলনের পরামর্শ দিচ্ছেন এবং স্কুলের পরিবেশ নিরাপদ রাখার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করছেন।
আবদুল বাতেন বলেন, “সীসার বিষক্রিয়ায় অনেক গুরুতর স্বাস্থ্য-সমস্যা হতে পারে। দৈনন্দিন ব্যবহৃত বিভিন্ন বস্তু যেমন শিশুর খেলনা, চকচকে খাবারের প্যাকেট ও প্রসাধনী সামগ্রী থেকেও এই বিষক্রিয়া হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “কর্মশালায় আমাদেরকে ন্যাশনাল ক্লিনিকাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণে আমি সীসার বিষক্রিয়ার উৎস, উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত বস্তু, কীভাবে শিশুরা এই সীসার সংস্পর্শে আস্তে পারে এবং কীভাবে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব- এসব বিষয় সম্পর্কে শিখেছি।”
নীরব ঘাতকের সঙ্গে লড়াই
বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ প্রচেষ্টায় গ্রামাঞ্চলে সীসার বিষক্রিয়া প্রতিরোধে আবদুল বাতেনের মতো শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগটি বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে আয়োজিত এই কর্মশালায় ৪১৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী ও শিক্ষক সীসার বিষক্রিয়া বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও কার্যকরী প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। আবদুল বাতেন তার অর্জিত জ্ঞান সব শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আবদুল বাতেন বলেন, “মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সীসার মারাত্মক প্রভাব সম্পর্কে আমি খুব কমই জানতাম। এখন আমার এ বিষয়ে ভালো জ্ঞান হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে, প্রতিদিনের সমাবেশে এবং বিভিন্ন ধরনের উপস্থাপনায় আমার সেই জ্ঞান ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। এই স্কুলে ২৫০ জন শিক্ষার্থী আছে এবং আমরা তাদের বেশিরভাগকে সচেতন করতে সক্ষম হয়েছি।”
আবদুল বাতেনের মতো প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের কাজের পরিধি কেবল শ্রেণিকক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় মির্জাপুরের বিপুল সংখ্যক মানুষ সীসার বিষক্রিয়া এবং এই সংকট কাটিয়ে ওঠার উপায় সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছে। তারা সক্রিয়ভাবে সমাজের মানুষকে দৈনন্দিন জীবনে সীসার ঝুঁকি চিহ্নিত করার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন।
শিক্ষক আবদুল বাতেন এখন আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেন, “কীভাবে সীসা মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে, কী কী বস্তু সীসার বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে এবং পারিবারিক অনুষ্ঠান, সামাজিক সমাবেশ, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় কীভাবে নিরাপদ থাকা যায়, সে সম্পর্কে সব সময় আমি কথা বলার চেষ্টা করি। মির্জাপুরের মানুষ এখন জানে কী ধরনের চকচকে বস্তু সীসার বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে, কোন খেলনা ও প্রসাধনীতে বেশি সীসা রয়েছে এবং নিরাপদ থাকতে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।”
কাহিনীতে পরিবর্তন
মির্জাপুর সীসার বিষক্রিয়া সম্পর্কে এখন সচেতন। সীসার বিপদ ও ঝুঁকি কমিউনিটিতে আর অজানা নয়। সীসার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে আবদুল বাতেন একা নন। ইউনিসেফ বাংলাদেশ এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরকে (ডিজিএইচএস) সহায়তা করছে। তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, অ্যাডভোকেসি ও অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সামাজিক আচরণ পরিবর্তনে যোগাযোগ কার্যক্রমের উপর গুরুত্বারোপ করে নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ইউনিসেফের পক্ষ থকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
ইউনিসেফের জোরালো প্রচেষ্টায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দেশের ৪ টি জেলার ২৪৩টি স্কুলের ৫৩৮ জন শিক্ষক সীসার বিষক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তারা এখন স্থানীয় স্কুল ও কমিউনিটিতে সীসার বিষক্রিয়া প্রতিরোধ কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আবদুল বাতেনের নিবেদিত প্রচেষ্টায় মির্জাপুরের কাহিনী এখন অজ্ঞানতা থেকে ক্ষমতায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সীসার উৎস থেকে নিজেদের রক্ষা করতে শেখার পর ‘মা ফাতেমা স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ এর শিক্ষার্থীরা এখন কমিউনিটির সবাইকে নিয়ে সীসার বিষক্রিয়ামুক্ত একটি নিরাপদ সমাজ গঠনের পথে নিবেদিত। একটি একটি করে শ্রেণীকক্ষে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে গোটা কমিউনিটিকে সোচ্চার করার বিষয়ে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।