নীরব কিন্তু প্রাণঘাতী শত্রুর বিরুদ্ধে তরুণ মহীনের লড়াই
মির্জাপুরে সিসাদূষণের প্রাণঘাতী প্রভাব মোকাবিলায় শিশু ও কমিউনিটিকে সহায়তা করছে ইউনিসেফ
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এলাকার নির্মল সৌন্দর্যের সাথে অনেকেই পরিচিত। তবে এখনও অনেকেরই অজানা যে এলাকাটি অদৃশ্য সিসাদূষণের সাথে ক্রমাগত লড়াই করে চলেছে।
মির্জাপুরে সিসাদূষণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা একটি এলাকা গোড়াইয়ে মহীনের বাড়ি। ১৪ বছর বয়সী এই কিশোর স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। কোন ছাড়পত্র ছাড়া গড়ে তোলা একটি সিসা-এসিড ব্যাটারি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ কারখানা কীভাবে তার কমিউনিটিতে বিপর্যয় নিয়ে এসেছে এবং ইউনিসেফ ও এর অংশীজনদের সহায়তা নিয়ে সে কীভাবে এই নীরব শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহযোগিতা করছে, সেই গল্প আজকে আমরা জানবো।
অদৃশ্য এক বিপদ
“ব্যাটারি কারখানা বন্ধ হওয়ার আগে শিশুরা নিয়মিত এই এলাকায় খেলত। প্রায়ই তারা এখান থেকে ব্যবহৃত ব্যাটারি, ধাতুর কোন টুকরো কিংবা ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র বাড়িতে নিয়ে যেত। তারা জানত না যে এগুলোতে উচ্চ মাত্রায় সিসার উপস্থিতি রয়েছে”, উদ্বিগ্ন কন্ঠে মহীন বলে।
কমিউনিটিতে তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রভাব না দেখা গেলেও, বাড়িতে ওই সব জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া বহু শিশু আস্তে আস্তে মাথাব্যথা, কাশি ও শ্বাসকষ্টের মতো শ্বাসতন্ত্রের নানা সমস্যায় ভুগতে শুরু করল।
“মহীন সব সময় একজন স্বাস্থ্যবান ছেলে ছিল। কিন্তু ওই কারখানার ধোঁয়া এই এলাকায় ছড়ানোর পর সে দীর্ঘ সময় ধরে অসুস্থ ছিল। আমরা ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালাম, কিন্তু কিছুই ধরা পড়ল না। সমস্যাটি বোঝা গেল মাত্র কিছু দিন আগে। তার রক্তে সিসার পরিমাণ ৭.৯৭ মাইক্রোগ্রাম/ডেসিলিটার ধরা পড়লে আমরা বড় একটা ধাক্কা খেলাম”, মহীনের মা মোরশেদা বলেন। রক্তে সীসার এই মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সীমা ৫ মাইক্রোগ্রাম/ডেসিলিটারের চেয়ে অনেক বেশি এবং এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
কমিউনিটির পরিবেশেও সিসাদূষণের বিরূপ প্রভাব পড়ে। মহীন বলে, “আমি গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে শুনেছি, এই কারখানা গড়ে তোলার পর থেকে এলাকার ফলমূল, শাক-সবজি ও শস্যের মান খারাপ হতে শুরু করে। আগে দ্রুত এগুলোর ফলন হলেও এখন তেমনটা হচ্ছে না। বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে দুটো গরুও মারা গেছে।”
এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরাও শিশুদের মতো একই ধরনের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভুগছে।
অদৃশ্য সীসাদূষণের প্রভাব উন্মোচন
ইউনিসেফের সহায়তায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ২০২২ সালে রক্তে সিসার পরিমাণ নিয়ে একটি জরিপ (ব্লাড লেড লেভেল-বিএলএল সার্ভিলেন্স স্টাডি) পরিচালনা করে। সেখানে চার জেলার ৯৮০জন শিশুর রক্তে সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়, এবং তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি শিশুর রক্তে সিসার পরিমাণ ডব্লিউএইচও নির্ধারিত ৫ মাইক্রোগ্রাম/ডেসিলিটারের চেয়ে বেশি ছিল।
শুধু বাংলাদেশেই সাড়ে তিন কোটি শিশু সিসাদূষণের শিকার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দ্য ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের (আইএইচএমই) তথ্য মতে, বিশ্বে সিসাদূষণে যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়, সেই তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ।
সিসাদূষণ মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সংকট তৈরি করে থাকে। রক্তে খুব অল্প পরিমাণে সিসার উপস্থিতিও অনেক জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিস্তার করে। এতে মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, স্মৃতিশক্তির সমস্যা, মনোযোগ কমে যাওয়া, স্নায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব এবং ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্ততা তৈরি হয়।
শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রভাব ছাড়াও সিসাদূষণের কারণে শিশুদের পড়াশোনা, স্কুলে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম, স্বাস্থ্য, সার্বিক কল্যাণ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হয়।
সিসাদূষণজনিত বড় ধরনের এই হুমকি দীর্ঘমেয়াদে থেকে যায়। তাই এর জন্য প্রয়োজন হয় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের। শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এর থেকে দ্রুত প্রতিকার ও প্রতিরোধের প্রয়োজন। এছাড়া সিসাদূষণের কারণে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা বিভিন্ন হৃদরোগে (কার্ডিওভাস্কুলার) ভুগে থাকেন, বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা অপরিণত শিশু জন্মদান বা গর্ভপাতের ঝুঁকিতে থাকেন।
পরিবর্তনের সূচনা
সিসাদূষণজনিত মারাত্মক এই সংকট মোকাবিলায়, ‘পিউর আর্থ’এর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইউনিসেফ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (এমওএইচএফডব্লিউ) অধীনস্থ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে (ডিজিএইচএস) কারিগরি ও আর্থিক উভয় ধরনের সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাথমিকভাবে ‘প্রটেকটিং এভরি চাইল্ড’স পোটেনশিয়াল (পিইসিপি)’ উদ্যোগের মাধ্যমে এই সহায়তা দেওয়া হয়। এটা ২০২০ সালের শেষ দিকে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত চলে। আর বর্তমানে চলমান ‘হেলদি এনভায়রনমেন্টস ফর হেলদি চিলড্রেন (এইচইএইচসি)’ কর্মসূচির আওতায় এই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এই কর্মসূচি চলছে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে।
ইউনিসেফ, কর্মসূচি পরিকল্পনা থেকে শুরু করে গবেষণা, মনিটরিং, নীতি প্রণয়ন ও পর্যালোচনা, সক্ষমতা তৈরি, অ্যাডভোকেসি এবং সামাজিক আচরণে পরিবর্তন (SBC) আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণসহ সার্বিক ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। এসব প্রচেষ্টার লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে কার্যকরভাবে সিসাদূষণ প্রতিরোধ করা এবং সিসাদূষণের প্রভাব সামাল দেওয়া, যাতে শিশুদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতে বাংলাদেশের কৌশলগুলো আরও জোরদার হয়।
এছাড়াও, ইউনিসেফ সিসাদূষণ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জাতীয় ক্লিনিক্যাল নির্দেশিকা এবং সিসাদূষণ নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরিতেও সহায়তা করেছে। উপরন্তু জাতীয় ও স্থানীয়/জেলা পর্যায়ে সিসাদূষণ নিয়ে প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষক হিসেবে ভূমিকা রাখবেন এমন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ৩৫ জন পেশাজীবীর একটি দল তৈরি করেছে ইউনিসেফ। এসকল প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসক, নার্স, ধাত্রী ও প্যারামেডিকসহ ৬৪৮ জন স্বাস্থ্য সেবা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের পাশাপাশি ৫৩৮ জন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এই প্রশিক্ষণে তাদেরকে নিজেদের স্কুল ও কমিউনিটিতে সিসাদূষণ প্রতিরোধের পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
কমিউনিটির ক্ষমতায়ন
মহীন তার স্কুলের শিক্ষকদের কাছে জেনেছে, সিসা কীভাবে মানুষের দেহে প্রবেশ করে, এটা কী কী ক্ষতি করতে পারে, কোন কোন নিত্য ব্যবহার্য জিনিসে উচ্চ মাত্রায় সিসা থাকে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব কীভাবে এড়ানো যায়।
মহীন বলে, “আমাদের শিক্ষকেরা বলেছেন, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র যেমন উজ্জ্বল তৈজসপত্র, শিশুদের খেলনা, ব্যাটারি, রং, এমনকি কিছু খাদ্যপণ্যেও সিসা পাওয়া যেতে পারে। তারা এসব জিনিস থেকে আমাদের দূরে থাকতে বলেছেন।’
মৃদুভাষী এই কিশোর এখন সিসাদূষণ নিয়ে স্কুল থেকে যে জ্ঞান অর্জন করেছে, সেগুলো তার সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশী শিশু এবং অন্যান্য অংশীদারদের কাছে তুলে ধরে। সিসাদূষণের মারাত্মক প্রভাব এবং কীভাবে প্রাণঘাতী এই শত্রুকে এড়ানো যায়- সেসব বিষয়ে নিজের এলাকার অনেক তরুণকেই অবহিত করেছে সে।
“আমি আমার বন্ধুদেরকে সিসাদূষণের খারাপ প্রভাব সম্পর্কে বলার পর তারা এখন এর ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছে। আমি এখন জানি যে, সবাইকে সচেতন করা গেলে, একসঙ্গে সিসাদূষণকে পরাস্ত করা সম্ভব।”
মহীনের প্রচেষ্টায় তার কমিউনিটিতে পরিবর্তন আসছে। এক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরি এবং জরুরি নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ইউনিসেফের অব্যাহত সহায়তা ভূমিকা রাখছে। যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে সিসাদূষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ জোরদার করতে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ। পাশাপাশি সিসাদূষণের বিরুদ্ধে অব্যাহত লড়াইয়ের জন্য ইউনিসেফ শুধু ব্যক্তিবিশেষ নয়, পুরো কমিউনিটিগুলোকে প্রয়োজনীয় সম্পদ ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করছে।