ভয়ের সামনে জয়: শিশু নির্যাতন ও সহিসংতার বিরুদ্ধে লড়াই
ইউনিসেফ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের স্পোর্টস ফর ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচিটি আত্মরক্ষা ও খেলাধুলার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের ক্ষমতায়ন করছে
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
বরিশাল সদরের বিসিক শিল্প এলাকার বাসিন্দারা দারিদ্র্যের কঠিন বাস্তবতার সাথে লড়াই করে চলেছে। নিত্য দিনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতেই বেশ হিমশিম খেতে হয় তাদের। দারিদ্র্যের এই নির্মম বাস্তবতার মুখে অনেক শিশুর শৈশবই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
দরিদ্র এই পরিবারগুলোতে হরহামেশাই ঘটতে দেখা যায় শিশু বিয়ে, শিশু শ্রম, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচার, মাদকাসক্তি ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার (জিবিভি) মতন অপরাধগুলোকে। আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে শিশুদের ভবিষ্যৎ। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন, কার্যকরী পদক্ষেপ যা শিশুর শারীরিক ও মানসিক অবস্থাকে বুঝে তাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে। তাকে যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে শেখাবে।
প্রান্তিক শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষমতায়ন
ইউনিসেফ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের (এমওওয়াইএস) সহায়তায় স্পোর্টস ফর ডেভেলপমেন্ট (এসফরডি) বা ‘উন্নয়নের জন্য খেলাধুলা’ কর্মসূচি চালু করেছে। সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সহিংসতা, শোষণ, নির্যাতন ও অবহেলা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে কর্মসূচিটি বেশ কার্যকরী ও সময়োপযোগী।
‘এসফরডি’ কর্মসূচির লক্ষ্য কেবল খেলাধুলা শেখানো নয়; বরং এটি শিশুর জন্য নিরাপদে খেলতে পারার ও তার শৈশবকে উপভোগ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে। অনেক যাচাই-বাছাই ও গবে করে সাজানো হয়েছে এই কর্মসূচিটি। এর আওতায় শিশুরা আত্মরক্ষার নানান কৌশলের পাশাপাশি ফুটবল, ভলিবল, কাবাডি ও সাঁতারসহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়।
এভাবে শিশুদের মাঝে নিষ্ঠা, অনুশীলন, নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। মেয়েশিশুরা উপলব্ধি করে যে, কোন খেলাকেই জেন্ডারের আওতায় বেঁধে রাখা যায়না; বিশ্বাস করতে শেখে যে, খেলাসহ জীবনের যেকোন ক্ষেত্রে ছেলেদের মতন মেয়েদেরও সমান অধিকার রয়েছে।
এভাবে খেলোয়াড়দের পাশাপাশি তাদের কমিউনিটিতেও সচেতনতা তৈরী হয়। নতুন এই আত্মপ্রত্যয় নিয়ে শিশুরা তাদের পারিপার্শ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে শেখে।
এসফরডি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রয়েছে ১২ বছর বয়সী উদ্যমী ফারজানা। এসফরডি কর্মসূচির মাধ্যমে নতুন আত্মবিশ্বাস অর্জনের বিষয়টি তুলে ধরে ফারজানা বলে, ‘কেউ আক্রমণ করলে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করব তা আমি শিখছি।’ সে নিয়মিত বরিশাল সদরের বিসিক শিল্প এলাকার খোলার মাঠে ৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী প্রায় ৫০ জন শিশু ও কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীরা বেশিরভাগই মেয়ে। ফারজানা এবং তার মতো অসংখ্য মানুষের জন্য এসফরডি কর্মসূচিটি শারীরিক সুরক্ষার চেয়ে অনেক বেশি কিছু, এটি তার সামগ্রিক বিকাশে সহায়তা করেছে; তাকে নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে দৃঢ় করে তুলেছে, ছেলেদের সমকক্ষ ভাবতে শিখিয়েছে।
নিরাপদভবিষ্যতের জন্য আত্মরক্ষা
‘এই দেশে কিংবাবিশ্বের অন্য যেকোনো স্থানে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে শিশু ও কিশোরর-কিশোরীরা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় না - বিশেষ করে যদি তারা হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হয়,’ বলেন ২৩ বছর বয়সী প্রশিক্ষক নওরিন আক্তার তিন্নি। তিনি আরও বলেন, ‘মেয়েরা বেশি এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে থাকে। কারণ তারা নির্যাতনকারী ও হামলাকারীদের জন্য সহজ লক্ষ্য। আত্মরক্ষার প্রধান কৌশলগুলো শেখা থাকলে, তাদের নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশেও তা ভূমিকা রাখে। আত্মবিশ্বাস গড়ার পাশাপাশি এটি শিশুকে শারীরিক ও মানসিকরুপে সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।’
এই শিশুদেরকে সঠিক আত্মরক্ষার সামগ্রী সরবরাহ করা অপরিহার্য। আত্মরক্ষার কৌশল জানা থাকলে, নিজেদের পাশাপাশি, অন্যদেরও সহায়তা করা যায়। এভাবে তারা আত্মনির্ভরশীল ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে শেখানো সাতটি আত্মরক্ষার কৌশলের সবগুলো আয়ত্ত করতে পারার উত্তেজনা ও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে এই কর্মসূচির আরেক ছোট শিক্ষার্থী লামিয়া বলে, 'যদি কেউ আমাদের কাউকে আঘাত করার চেষ্টা করে তাহলে আমি নিজেকে, আমার বন্ধুদেরকে, আমার মা ও আমার বোনকেও রক্ষা করতে পারব।'
খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা অনুশীলন ও নিয়মানুবর্তিতাশেখে। তারা সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতে শেখে যার প্রভাব দেখা যায় তাদের স্বাস্থ্যের উপরও। নেতৃত্ব দেওয়া এবং একসঙ্গে দলে খেলার মাধ্যমে নিজের ও অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তারা জীবনকে উপভোগ করতে শেখে, ভালবাসতে শেখে।তাদের মধ্যে জীবনের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। ‘শিশুদের হাসি দেখলে আমার কাজকে অর্থবহ মনে হয়। শিশুদের উপর খেলাধুলার প্রভাব বেশ চমৎকার, অনেকটা জাদুর মতন,’ শ্রদ্ধাবোধ থেকে বলেন তিন্নি।
দুর্বলতাকে সাহসে রূপান্তর
এসফরডি কর্মসূচির আওতায়, বরিশালে ৪ জন প্রশিক্ষক, কমিউনিটি মোবিলাইজার (সিএমএস) ও কমিউনিটি ফ্যাসিলিটেটরদের (সিএফএস) সাথে নিয়ে মাত্র ৪ দিনে ১০০ জন অংশগ্রহণকারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই মেয়ে। পাশাপাশি তাদের বাবা-মা, কমিউনিটির অন্যান্য সদস্য ও পরিচর্যাকারীদের শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ও ক্ষতিকর নানান সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বিভিন্ন সচেতনতা ও প্রশিক্ষণমূলক সেশনে যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। , । ২০২২ সালের এপ্রিল মাস থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় নব্বই লাখ শিশু, কিশোর-কিশোরী, অভিভাবক ও কমিউনিটির সদস্যগন এসফরডি কর্মসূচির আওতায় সহায়তা পেয়েছেন।
ইউনিসেফ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের মাঝে শুরু থেকেই সাহস সঞ্চার করে একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর ধারাবাহিকতায়, এসফরডি কর্মসূচির পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে; বাড়বে সুবিধাভোগী শিশু ও তাদের পরিবারের সংখ্যা। তারা হয়ে উঠবে আরও সাহসী ও অদম্য।
যত বেশি সংখ্যক শিশু ক্ষমতায়িত হবে, যত বেশি কমিউনিটি সম্পৃক্ত হবে, তত কাছে আমরা পৌঁছে যাব প্রত্যেক শিশুর জন্য একটি সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার আমাদের লক্ষ্যের কাছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের (এমওওয়াইএস) দৃঢ় সমর্থন নিয়ে এই রূপান্তরমূলক যাত্রা অব্যাহত থাকবে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য অসংখ্য শিশু ও কিশোর-কিশোরীর জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।