শিশুদের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মীর পথচলা
শিশু অধিকার রক্ষায় সমাজকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার দেশজুড়ে উল্লেখযোগ্য হারে সমাজসেবা কর্মীদের সংখ্যা বাড়িয়ে শিশু সুরক্ষার কার্যক্রম জোরদার করেছে
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
বাংলাদেশে ১৪ বছরের কম বয়সী প্রায় সাড়ে চার কোটি শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে; তাই প্রয়োজন বলিষ্ঠ শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমের।এই জরুরি প্রয়োজনকে উপলব্ধি করে বাংলাদেশ সরকার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে- তা হলো প্রশিক্ষিত সমাজকর্মীদের ঘাটতি পূরণ করা। দেশে শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে সরকার ইতিমধ্যে কমিউনিটি পর্যায়ে শিশু ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কাজ করার জন্য এক হাজার ২৩৯ জন সমাজকর্মী এবং ২১ জন মনোসামাজিক কাউন্সেলর নিয়োগ দিয়েছে। এর ফলে এই সেবায় কর্মীর সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
ইউনিসেফের সহযোগিতায় রংপুর, রাজশাহী, সিলেট ও কক্সবাজারে উপজেলা পর্যায়ে শক্তিশালী এক শিশু সুরক্ষা সিস্টেম তৈরী করা হয়েছে যার আওতায় বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমের মতো ক্ষতিকর চর্চার মোকাবিলার পাশাপাশি শিশুদের প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন, অবহেলা ও বঞ্চনা রোধ করতে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সবার জন্য কার্যকরী শিশু সুরক্ষা পরিষেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত সংখ্যায় দক্ষ সমাজকর্মীর। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন এজেন্সির (এসআইডিএ) সহযোগিতায় ইউনিসেফ সমন্বিত প্রশিক্ষণ ও অ্যাডভোকেসি কর্মসূচির মাধ্যমে দেশজুড়ে সমাজসেবা কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে।
ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের সুরক্ষা
অসহায় শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সমাজসেবা কর্মকর্তা ও কর্মীদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের মধ্যে কুড়িগ্রামের উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা (ইউএসএসও) এস এম হাবিবুর রহমানের গল্পটা দৃষ্টান্তস্বরূপ।
হাবিবুর নিজেও একজন বাবা। তার মতে কমিউনিটির অন্য শিশুরা যখন সমস্যায় থাকে তখন শুধু নিজের সন্তানদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যথেষ্ট নয়। এই উপলব্ধি থেকে তিনি সহিংসতা, নিপীড়ন ও অবহেলার ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের শনাক্ত এবং তাদের জন্য রেফারেল সেবা নিশ্চিত করতে সমাজকর্মী ও কমিউনিটির সদস্যদের সম্পৃক্ত করতে অনুপ্রাণিত হন। তিনি ২০১৫ সালে ইউনিসেফ ও সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উদ্যোগে আয়োজিত শিশু সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ‘বেসিক–প্রফেশনাল সোশ্যাল সার্ভিসেস ট্রেনিংয়ে’ (বিএসএসটি–পিএসএসটি) যোগ দেন। এই প্রশিক্ষণ থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তিনি শিশু সুরক্ষা বিষয়ক কাজে আরও পটু হয়ে ওঠেন, আর এভাবেই তিনি নিজ কমিউনিটি তথা সারাদেশে শিশু সুরক্ষার যে অগনিত চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো মোকাবিলায় অনন্য এক চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছেন।
ইউনিসেফের চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) প্রকল্প ও সমাজ সেবা কার্যালয়ের সহায়তায় হাবিব ছয়জন সমাজকর্মীর একটি দল গড়ে তোলেন। এই দল নিয়ে তিনি কুড়িগ্রামের অসহায় শিশু ও তাদের পরিবারকে চিহ্নিত করা এবং কুড়িগ্রামে শিশু সুরক্ষা নিশ্চিতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় বের করার মিশনে নেমে পড়েন। তাঁর নেতৃত্বে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সমাজকর্মীরা উপজেলার ভেতরে একটি সমন্বিত শিশু সুরক্ষা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। এই নেটওয়ার্ক কমিউনিটি পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবী ও কমিউনিটিভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটিগুলোর সদস্যদের, ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের খুঁজে বের করার কাজে এবং সমাজর্মীদের মাধ্যমে তাদেরকে প্রয়োজনীয় সেবাসমূহে রেফার করার কাজে সম্পৃক্ত করে থাকে। প্রতি মাসে প্রত্যেক সমাজকর্মী এ ধরনের ৫টি শিশুকে শনাক্ত করেন; ২০২২ সালে হাবিব ও তাঁর দল বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা এক হাজার ১০৪জন কিশোরীর জন্মনিবন্ধন করাতে সহায়তা করেছেন। এই শিশুকন্যাদের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের মাধ্যমে তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের ভিত গড়ে দেয় তারা।
ইউএসএসও হাবিবুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে শিশু সুরক্ষা যে পরিস্থিতি আছে তাতে অসহায় শিশুদের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে একটি বড় ধরনের রূপান্তর দরকার। বাংলাদেশে শিশু সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি প্রাথমিক বাধা হয়ে আছে দারিদ্র্য। অসহায় শিশু ও তাদের পরিবারকে কার্যকরভাবে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই পরিবারগুলোকে উপার্জনক্ষম কাজে যুক্ত করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাতেই পরিবারগুলো সন্তানের যথাযথ দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা অর্জন করবে।”
হাবিব, এক আশ্রয় কেন্দ্রে বড় হওয়া ১৮ বছর বয়সী একজন এতিম ছেলেকে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের শহর সমাজ সেবা (ইউসিডি) কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত কম্পিউটার ক্লাসে ভর্তি করেন। হাবিবের তত্ত্বাবধায়নে ছেলেটি এখন একজন দক্ষ কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে শিশু সুরক্ষা ডকুমেন্টেশন কার্যক্রমে সহায়তা করছেন।
কমিউনিটিকে সংগঠিত করা
হাবিব তার কমিউনিটিতে সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। একই বছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সহায়তা নিয়ে তিনি একটি সচেতনতা বৃদ্ধির ক্যাম্পেইন শুরু করেন। এতে নির্বাচিত কন্যাশিশুদের অভিভাবক ও শিক্ষক মিলিয়ে এক হাজার ব্যক্তির কাছে বাল্যবিবাহের মারাত্মক পরিণতি এবং তা প্রতিরোধের উপায়গুলো তুলে ধরা হয়। ক্যাম্পেইনের আওতায়, স্থানীয় নিকাহ নিবন্ধকদের ও কাজীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।পাশাপাশি আয়োজন করা হয় ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট চাইল্ড হেল্পলাইন (সিএইচএল)–১০৯৮ বিষয়ে প্রশিক্ষণের।
এছাড়াও শিশু সুরক্ষায় কমিউনিটিকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে, ইউনিসেফ ও সমাজ সেবা অধিদপ্তরের কারিগরি সহায়তায় হাবিব কুড়িগ্রাম উপজেলার ওয়ার্ডজুড়ে মোট ৭২ টি কমিটি গঠন করেন; এর সাথে যুক্ত করেন এক হাজারেরও বেশি সদস্যকে। এসব কমিটি তৃণমূল পর্যায়ে শিশু সুরক্ষার নানা বিষয়ে সমাজকর্মীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে। এভাবে দেখা যায় দিন বদলের হাওয়া।
এ কাজের জন্য যাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হাবিব বলেন, “কয়েক বছরে কুড়িগ্রামের বঞ্চনার শিকার শিশু ও তাদের পরিবারগুলোর অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার জন্য তারা শক্তি ও আত্মবিশ্বাস পেয়েছে। একইসঙ্গে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অব্যাহত সহায়তার মধ্য দিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে।”
একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে হাবিব প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্যও কাজ করছেন; তিনি নিয়মিত প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ প্রচালনা করেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের পরিবারগুলোকে সহায়তার জন্য তিনি সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করছেন।
একটি দুর্ঘটনায় পা হারানো ১৬ বছর বয়সী লিমা বলে, “প্রতিবন্ধী সনদ ও ভাতা পেতে ইউএসএসও হাবিবুর রহমান আমাকে সহায়তা করেছেন। এর ফলে আমি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পেরেছি এবং এবার এসএসসি পরীক্ষায় বসতে পেরেছি। এছাড়া আমার জন্য একটি কৃত্রিম পা–এর ব্যবস্থা করতে তিনি আমার পরিবারকে সহযোগিতা করেছেন। এতে আমার জীবনের অনেক অপূর্ণতা ঘুচেছে। শিশুদের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে আমি ভবিষ্যতে একটি সরকারি স্কুলের একজন শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখি। আমি সব সময় ইউএসএসও হাবিবুর রহমান ও তার দলের মহানুভবতা ও প্রচেষ্টা মনে রাখব।”
দেশজুড়ে শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম জোরদার
নিজের কমিউনিটির কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য হাবিব যে নিষ্ঠা দেখিয়েছেন, তা তার পেশাগত দায়িত্বের পরিসর ছাড়িয়ে গেছে। তিনি শিশু অধিকার এবং শিশু নিপীড়ন ও বঞ্চনার ঘটনা তুলে ধরার গুরুত্ব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কমিউনিটি পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন। কমিউনিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক, কর্মশালা ও সচেতনতা তৈরির ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তিনি অভিভাবক, শিক্ষক ও কমিউনিটির নেতাদের শিশু সুরক্ষা বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার জন্য ক্ষমতায়িত করেছেন, সমাজে এ বিষয়ে নজরদারি ও জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন।
বাংলাদেশ শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার যাত্রা অব্যাহত রাখায় হাবিবের মতো সমাজ সেবা কর্মীদের গল্পগুলো, প্রান্তিক কমিউনিটিতে এই পেশাজীবীরা কী ভূমিকা রাখতে পারেন তার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সমাজসেবায় নিয়োজিত কর্মীবাহিনীতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং তৃণমূলের উদ্যোগগুলোকে সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশ শিশুদের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে দিচ্ছে, যেখানে শিশুদের জন্য নিরাপত্তা ও সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
এই প্রবন্ধটি ইউনিসেফ বাংলাদেশের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার কনসালট্যান্ট সায়মা ফেরদৌসীর তৈরি একটি কেস স্টাডি থেকে রেফারেন্স নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।