আপনার শিশুর প্রথম খাবার: মিনি প্যারেন্টিং মাস্টার ক্লাস
"ধৈর্য, একাগ্রতা ও অনেক অনেক ভালোবাসা।" আপনার শিশুকে প্রথম খাবারের সঙ্গে কীভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে, সে সম্পর্কে একজন পুষ্টি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ।
- পাওয়া যাবে:
- বাংলা
- English
শিশুদের জন্য সেরা প্রথম খাবার কী কী? শিশু খেতে না চাইলে বা খাবার প্রত্যাখ্যান করলে আমাদের কী করা উচিত? শিশুদের প্রথম খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের যে বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন সে সম্পর্কে জানতে আমরা পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. পূর্ণিমা মেননের সঙ্গে কথা বলেছি।
'শিশুর প্রথম খাবার বিষয়ক মিনি প্যারেন্টিং মাস্টার ক্লাস' ভিডিওর ট্রান্সক্রিপ্ট
শিশুদের খাওয়ানোর মানে কেবল তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া নয়। এটি তাদের জন্য খাওয়া শেখারও বিষয়। এটি তাদের খাওয়া উপভোগ করতে শেখার বিষয়। এটি বাবা-মা ও শিশুদের মধ্যে একটি ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়ার বিষয় এবং সেই ইতিবাচক সম্পর্কের অংশ হওয়া চাই খাওয়া।
আমার নাম ডা. পূর্ণিমা মেনন এবং এটি শিশুর প্রথম খাবার বিষয়ক আমার মিনি প্যারেন্টিং মাস্টার ক্লাস।
আমার শিশু কখন তার প্রথম খাওয়ার চেষ্টা করার জন্য প্রস্তুত হয়?
শিশুদের প্রথম খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ছয় মাস বয়স হলো সঠিক সময়। এটি এমন সময় যখন মায়ের বুকের দুধ পুষ্টির চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আর যথেষ্ট থাকে না। একইসঙ্গে এটি এমন সময় যখন শিশুরা শারীরিক বিকাশের মাধ্যমে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় এবং নিজেরাই নতুন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাই ছয় মাস বয়স প্রায়ই সঠিক সময়।
শিশুদের জন্য সেরা প্রথম খাবার কী কী?
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই প্রথম খাবারগুলো আমাদের পক্ষে যতটা করা সম্ভব ততটাই পুষ্টিতে ভরপুর হবে। তাই এটি হতে পারে গাজর, কুমড়া ও মিষ্টি আলুর মতো রঙিন সবজির মিশ্রণ। নানা রঙের মিশ্রিত ফলও শিশুদের প্রথম খাবার হিসেবে দারুণ। আপনার পরিবার যদি মাংস খায়, তবে শিশুকে নরম করে মাংস খাওয়াতে পারেন। ডিম শিশুদের জন্য একটি দুর্দান্ত প্রথম খাবার।
বাড়িতে যা খাচ্ছেন তার যে কোনোটিই আপনি পরিবর্তন করতে পারেন। আপনাকে শুধু এটি থেতলে নিতে হবে এবং শিশুদের জন্য এটিকে কিছুটা পিউরি বা নরম করতে হবে। আমরা এটাও নিশ্চিত করতে চাই যে, আমরা এমন খাবার এড়িয়ে চলি যেসব খাবারে শিশুদের জন্য ভিটামিন, প্রোটিন ও খনিজ থাকে না। তাই আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে, শিশুর প্রথম খাবারগুলো যাতে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত না হয়। আবার এগুলো অতিরিক্ত লবণাক্তও হবে না। তবে এগুলো মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য সঠিক পুষ্টি দিয়ে পরিপূর্ণ থাকবে।
কীভাবে আমার শিশুর জন্য প্রথম খাবার প্রস্তুত করা উচিত?
আপনি যদি শিশুদের ছয় মাস বয়সে প্রথম খাবার খাওয়ানো শুরু করেন, তবে আপনাকে অবশ্যই সেগুলো পিউরি বা নরম করতে হবে। প্রথম খাবার নরম হতে হবে। শিশুরা যেন এগুলো সহজে গিলে ফেলতে পারে। এখন আপনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটিকে মানানসই করে নিতে পারেন। তাই আপনি যখন প্রথমবার খাবারগুলো শিশুর মুখে দেবেন, তখন আপনাকে সেগুলো নরম করতে হবে। তবে শিশুরা একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি খাবারও সেভাবে মানানসই করে নিতে পারেন।
আমি কীভাবে প্রথম খাবারের সঙ্গে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দেওয়াকে আমার ও আমার শিশুর জন্য একটি মজার ও ইতিবাচক অভিজ্ঞতায় পরিণত করতে পারি?
শিশুর প্রথম খাবার শুধুমাত্র খাবারের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এটি সংস্কৃতির বিষয়, ভালোবাসার বিষয়। এটি শিশুদের আমাদের পরিবারের অংশ হতে শেখার বিষয়। আর বাবা-মায়েরা যদি সেই পুরো চিত্রটি মাথায় রাখেন, তবে এটি কেবলমাত্র আপনার শিশুর মুখে খাবার তুলে দেওয়া থেকে কিছুটা চাপ কমিয়ে দেয়। আর আমি মনে করি, আমরা সবচেয়ে ভালো যে কাজটি করতে পারি তা হলো- আমাদের নিজেদের মনে করিয়ে দেওয়া যে, শিশুরা শিখছে। আমরা কে তা তারা শিখছে। তারা শিখছে যে, আমরা পরিবার হিসেবে কী ধরনের খাবার খাই। তারা আরও শিখছে, তারা কী পছন্দ করে। কারণ স্বাদ না পাওয়া পর্যন্ত কী পছন্দ তা তারা জানে না। আর আমরা তাদের সম্পর্কে শিখছি যখন আমরা তাদের সেই খাবারগুলো উপভোগ করতে দেখি। তাই মানসিক চাপ না নেওয়া সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। ধৈর্য সহকারে একাগ্রতা নিয়ে এবং প্রকৃত অর্থে অনেক ভালোবাসার নিয়ে এটি এগিয়ে নেওয়া সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শেষ পর্যন্ত এটি শেখার বিষয়।
আমার শিশু প্রথম খাবার খেতে না চাইলে বা প্রত্যাখ্যান করলে আমার কী করা উচিত?
ওহ, শিশুরা সবসময় খাবার প্রত্যাখ্যান করে এবং আবারও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এটি তাদের শেখার বিষয়। আপনি নতুন কিছুর স্বাদ নিচ্ছেন। শিশুদের পক্ষে কখনও কখনও সেই স্বাদ প্রত্যাখ্যান করা খুব স্বাভাবিক এবং কখনও কখনও বিজ্ঞান আমাদের বলে যে শিশুদের কোনো কিছুর সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার আগে বেশ কয়েকবার তার স্বাদ নিতে হবে। তাই এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, বাবা-মায়েরা আশা হারাবেন না বা এমনটা ভাববেন না যে, শিশু একবার কোনো খাবার প্রত্যাখ্যান করেছে মানে তা চিরতরে প্রত্যাখ্যান করেছে। আর বাবা-মা হিসেবে আমরা যা করতে পারি তা হলো আরাম করা এবং পুনরায় চেষ্টা করা।
আমার কি শিশুকে চামচ দিয়ে খাওয়ানো উচিত নাকি তাকে নিজ নিজেই খাবার নিতে দেব?
আপনি একটি চামচ দিয়ে বা খুব পরিষ্কার হাতে শিশুদের খাওয়াতে পারেন। হাত ধোয়া সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং নিশ্চিত করুন যে আপনি শিশুকে যা দিয়ে খাওয়াচ্ছেন তা যেন যতটা সম্ভব পরিষ্কার হয়। আবার, আমাদের একটি জিনিস মনে রাখতে হবে যে, শিশুরা শিখছে এবং তারা তাদের খাবারের প্রতি খুবই আগ্রহী। তাই শিশুদের খাওয়ানোর ক্ষেত্রে সত্যিই কিছুটা দেওয়া ও নেওয়ার মতো বিষয় থাকা দরকার। শিশুদের খাওয়ানোর একটি অংশ হলো বাবা-মায়েদের জন্য তাদের ইঙ্গিতগুলো শোনা ও দেখা, যাতে শিশুরা তাদের উদ্দেশ্যে যে সংকেত দেয় তা তারা বুঝতে পারেন। তারা যেমন নিজেরা খেতে পারে না, তেমনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে এবং কোনো কিছু আমরা যেভাবে উপভোগ করি তারা সেটা করতে না পারলে বা যখন তাদের পেট ভরে যায় তা আমাদের বলতেও পারে না। তারা মুখে আমাদের কিছু বলতে পারে না। আর তাই তারা সংকেত পাঠানোর জন্য বেশ কিছু অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করে।
যখন তারা একটু বড় হয় তখন যা হয় তা হলো, তারা তাদের খাবার স্পর্শ করতে এবং নিজের হাতেই খাওয়া শুরু করতে চায়। তাদের ৯ মাস থেকে এক বছর বয়সের মধ্যেই এটি শুরু হতে পারে। আমরা শিশুদের কী দিচ্ছি সেটি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তবে তারা তাদের খাবারকে কীভাবে গ্রহণ করবে সে বিষয়ে তাদেরও কিছুটা স্বাধীনতা আমাদের দেওয়া উচিত।
আমার শিশুকে কতক্ষণ পর পর শক্ত খাবার খাওয়ানো উচিত?
আপনি যখন প্রথম খাবার খাওয়ানো শুরু করবেন, তখন আপনি সেগুলো দিনে প্রায় তিন বা তার বেশি বার দেওয়া শুরু করুন। আর এরপর শিশুরা যত বড় হতে থাকবে এবং তাদের বয়স ৯ বা ১২ মাসে পৌঁছাবে, তখন আপনাকে সংখ্যা বাড়িয়ে দিনে চারবার খাওয়াতে হবে। পাশাপাশি আপনাকে খাবারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। কারণ শিশুকে ৬ মাস বয়সে আপনি যে পরিমাণ খাবার খাওয়াতেন সেই একই পরিমাণ খাবার ১২ মাস বয়সে খাওয়ালে তা শিশুর জন্য যথেষ্ট হবে না। শিশুরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে খাওয়ানোর সংখ্যা ও খাবারের পরিমাণ দুটোই বাড়াতে হবে।
শক্ত খাবার খাওয়ানো শুরু করার পর আমার কি বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাওয়া উচিত?
আপনার অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাওয়া উচিত হবে। বর্তমানে এটি সুপারিশ করা হয় যে, বুকের দুধ খাওয়ানো কমপক্ষে দুই বছর এবং সম্ভব হলে এমনকি তারপরও যেন অব্যাহত রাখা হয়। এক অর্থে, বুকের দুধ এবং বুকের দুধ যে পুষ্টি সরবরাহ করে তা শিশুদের জন্য ভালো পুষ্টির ভিত্তি। আর প্রথম খাবারগুলো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির অভাব পূরণ করে, যা শিশুর শরীর ও মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য প্রয়োজন।
বিকাশমান মস্তিষ্কের জন্য ভালো পুষ্টি প্রয়োজন। তাই প্রথম খাবারের মাধ্যমে আমরা যা অর্জন করি তা আসলে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করার জন্য সেই পুষ্টি নিয়ে আসে। শিশুদের জীবনের প্রথম কয়েক বছরে তাদের খাওয়ানোর জন্য বাবা-মায়েরা অনেক সময় ব্যয় করেন। খাওয়ানোর মুহূর্তগুলো খেলার সুযোগ এবং ভালবাসা প্রদর্শনের সুযোগ করে দেয়। এই মুহূর্তগুলো ভাষা শেখারও সুযোগ তৈরি করে। বাবা-মায়েরা শিশুদের খাওয়ানোর সময় তাদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের সঙ্গে খাবার নিয়ে কথা বলেন। প্রথম খাবার শুধু মস্তিষ্কের জন্য পুষ্টির বিষয় নয়। এটি পুষ্টি, খেলা, ইতিবাচকতাকে একত্রিত করার সুযোগ তৈরি করারও বিষয়, যে বিষয়গুলো, আমরা জানি যে, শিশুর মস্তিষ্ককে খুব ভালোভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।
ডা. মেনন ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো। তিনি ‘আন্তর্জাতিক পুষ্টি’ বিষয়ে কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুষ্টি বিষয়ে এমএসসি করেছেন।